অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো।
রিয়াজ সুমন : আপনি ঈদ কিভাবে উদযাপন করেন?
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : সারা বছরই তো ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়, ঈদের সময় বেশ কয়েকদিন একসাথে ছুটি পাওয়া যায়। তখন আত্মীয়স্বজন যারা আছেন তাদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়, তাদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো যায়। বিশেষত পরিবারের সাথে তো অবশ্যই কিছুটা সময় ব্যয় করতে পারি। আমার তিন বোন আছেন ঢাকা শহরে, আমার আব্বা আছেন, তাঁর বয়স ৯৬ বছর; ঢাকায় যাঁরা থাকেন আমার আব্বা আমার বোনরা তাদের সাথে কিছুটা সময় আমি দিতে পারি।
আর সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হল, এই সময়টা তো সবার সাথে আনন্দ ভাগ করার সময়- সেই চেষ্টা করি, যাতে করে শুধু নিজেদের আনন্দ নয়; আশপাশে যারা আছেন তাদের সাথেও আনন্দটা ভাগ করতে পারি।
রিয়াজ সুমন : এখনকার ঈদ এবং আপনার ছোটবেলার ঈদের মধ্যে পার্থক্য কী?
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : আমার জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর কেটেছে নানার বাড়িতে। সেটা ফেনীতে। মাঝে মাঝে দাদার বাড়ি যেতাম যেটা ছাগলনাইয়ে।
নানাবাড়িতে বড় হয়ে ওঠা আমার। তখন নানা ছিলেন, আমার মামারা ছিলেন, তাদের সাথে এবং গ্রামীন পরিবেশে সবার সাথে মিলিয়ে ঈদের সময় এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়া, সেমাই খাওয়া, আনন্দ করা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আনন্দ করা; সেটা ছিল অন্য ধরনের সময়।
রিয়াজ সুমন : আপনাকে আমরা সব সময় দেশের অর্থনীতি, গবেষণা এবং সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে শুনি।
আমরা আজ আপনার আপনার স্কুল জীবন ও বাল্যকাল সম্পর্কে জানতে চাই।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : ছোটবেলায় আমি আমার নানার বাড়িতে থেকে সোনাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি ক্লাস ফোর পর্যন্ত।
আমার বাবা তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মচারী ছিলেন এবং পরবর্তীতে তার কর্মস্থল হয় চাঁদপুরের মতলবে, সেই মতলবে তখন ক্লাস ফাইভে ভর্তি হই। সেখানে ক্লাস ফাইভ-সিক্স পড়ি এবং সেই স্কুল থেকে পরবর্তীতে পরীক্ষা দিয়ে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হই। মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম এবং ইন্টারমিডিয়েটে ইনফ্যাক্ট ঢাকা বোর্ডে আর্টসে ফার্স্ট হয়েছিলাম। তারপরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সে ভর্তি হই। ইকোনমিক্সে কিছুদিন ক্লাস করার পরে সরকারি বৃত্তি নিয়ে রাশিয়ায় গেলাম। সেখানে আমি প্রথমে আমি আমার আন্ডারগ্রেড করলাম। ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স করার পরে মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে পিএইচডি করলাম। এই পিএইচডি করার পরে দেশে চলে আসলাম।
রিয়াজ সুমন : আপনার কর্মজীবন কোথা থেকে শুরু হলো?
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : দেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম শিক্ষকতার জন্য। মাঝখানে আমি বিআইবিএমে কয়েক মাস কাজ করেছি। তারপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিস ফ্যাকাল্টিতে একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টে অর্থনীতি পড়ানোর নির্বাচিত হলাম। এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জীবন শুরু করে। তারপর তো ২৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। একই সাথে ১৯৯৩ সালে যখন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ করলেন প্রফেসর রেহমান সোবহান তখন তার সাথে সমান্তরালভাবে সেখানে কাজ করেছি।
রিয়াজ সুমন : এই শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশা ছেড়ে আপনি গবেষণায় চলে আসেন এবং এই সংস্থায় কাজ করার পেছনের গল্পটা যদি একটু বলতেন, কেন এলেন আপনি?
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : শিক্ষকতাটা আমার খুবই ভাল লাগতো এবং আমার সবসময় মনে হত যে আমার বোধহয় ন্যাচারাল প্রবণতাই হল শিক্ষকতার দিকে। ২৫ বছর পড়ালাম কিন্তু তারপরে আমাকে খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হল। ১৯৯৩ সালে যখন অধ্যাপক রেহমান সোবহান স্যার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ করলেন তখন আমি আমার সময়ের বড় অংশ শিক্ষকতার বাইরে তার সাথে থাকতাম, গবেষণা করতাম। সিপিডি গড়ে তোলার ব্যাপারে ডক্টর দেবপ্রিয় ও আমি স্যারের সাথে সবসময় ছিলাম। পরবর্তীতে যখন ডক্টর দেবপ্রিয় দেশের বাইরে চলে গেলেন, তিনি ছিলেন স্যারের পরে প্রথম নির্বাহী। তখন আমার একটা দায়িত্ব চলে আসলো বলা যায়। আমি চার বছরের জন্য এক্সট্রা অর্ডিনারি লিভ উইদাউট পে নিলাম। কিন্তু তারপর প্রশ্ন আসলো যে, এখন কি করা হয়, ছুটির পরে ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যাওয়া অথবা সিপিডিতে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসাবে এটা কন্টিনিউ করা। তো তখন সিপিডি গড়ে উঠছে, খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়; তখন আমি এই সিদ্ধান্তটা নিলাম।
রিয়াজ সুমন : আপনার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : ১৯৮৯ সালে আমাদের বিয়ে হয়। আমার একজন পরিচিত বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার মাধ্যমে আসলে আমাদের এই বিয়েটা অনেকটা বলা যায় ঘটকালির মাধ্যমেই হয়। খুব পূর্ব পরিচিত যে ছিল সেটা না। আমার স্ত্রী তখন একটা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। আমাদের দুউজন সন্তান। আমার ছেলে এখানে পড়াশোনা করে তারপরে আন্ডারগ্রেড এবং মাস্টার্স বাইরে করেছে। দেশে ফেরত এসে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। আইএফসিতে ছিল, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে ছিল, তারপর ইউএনডিপিতে তারপর আবার ব্যাংকে। সম্প্রতিকালে আমার মেয়েও আন্ডারগ্রেড এবং মাস্টার্স বাইরে করেছে৷ এখনও কানাডাতে পিএইচডি করছে মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কারদের উপরে। আমার স্ত্রী এক পর্যায়ে বাচ্চাদের পড়াশোনার দেখভাল ইত্যাদি করার জন্য স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন।
রিয়াজ সুমন : শিক্ষকতা তারপরে সিপিডির পাশাপাশি আপনি আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার সাথে কাজ করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা যদি বলতেন।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছি, কুইন এলিজাবেথ হাউসে ছিলাম, তারপরে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ফুলব্রাইট ফেলো হিসেবে ছিলাম। যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক ফেলো হিসেবে ছিলাম। তারপর সিঙ্গাপুরে, দিল্লিতে ও ইসলামাবাদসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফেলো হিসেবে কাজ করেছি।
রিয়াজ সুমন : স্যার, আমরা একটু অর্থনীতি নিয়ে জানতে চাই, আমাদের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : দেখুন মূল্যস্ফীতির একটা চাপ গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র প্রান্তিক মানুষ না, এখানে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত যারা আছেন, তারাও এই চাপের মধ্যে আছেন। আমাদের কর্মসংস্থান-বিনিয়োগ এগুলোও একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। আবার অন্যদিক থেকে অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। বৈদেশিক খাতটা একটা ইতিবাচক অবস্থার মধ্যে আছে, আমাদের এক্সচেঞ্জটা স্ট্যাবল আছে, রিজার্ভ যেভাবে অবনমন হচ্ছিল সেটা রোধ করা গেছে। আমদানি আরো একটু উদার করা সম্ভব হচ্ছে, যেটা নিয়ন্ত্রিত করতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। ব্যাংকিং সেক্টরকে কিছুটা পুনর্গঠন করা, সংস্কার করা; এগুলো সহজ না এবং এগুলো এই সরকারও পারবে বলে মনে হয় না। সেইজন্য সংস্কার কর্মসূচিগুলোকে শুরু করা, সেগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাতে তাদের অঙ্গীকার করেন, ইশতেহারে যাতে তাদের প্রতিফলন করেন। যাতে জনগণের কাছে তাঁরা বলেন এবং জনগণ যাতে সেটাকে মনিটর করতে পারে, একবার ইলেকশন হয়ে যাওয়ার পরে সেটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রিয়াজ সুমন : আপনারা তো শ্বেতপত্র করলেন এবং সেখানে আপনি সদস্য ছিলেন। তার মূল্যায়ন বর্তমান সরকার কিভাবে করেছে বা করছে।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : আমাদের ম্যানডেট ছিল ‘স্টেট অব দ্য ইকোনোমি’টা কি? প্রকৃত অবস্থা কি- আমরা সেটা বের করার চেষ্টা করেছি। কোন জায়গাগুলোতে সমস্যা আছে সেটা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হোক, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে হোক, ব্যাংকিং সেক্টরের ক্ষেত্রে হোক, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে হোক আমরা ‘স্টেট অব দ্য ইকোনোমি’টা কি- আমরা একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার কারণ তথ্য উপাত্তের অনেক বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখার প্রবণতা ছিল। তো সেটাকে আমরা চেষ্টা করছি যে প্রকৃত কী অবস্থা সেটা তুলে ধরার। আমরা যেরকম আশা করেছিলাম আশানুরূপভাবে হয়নি। এখন প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে বলা হচ্ছে, একটা হলেও সংস্কার যাতে তারা বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু আরো অনেক ব্যাপক এবং এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো একটা সাময়িক সময়ের জন্য আসছে; তাঁরা যে সবটা করতে পারবেন তা না, তবে একটা ভালো শুরু তাঁরা করে দিতে পারেন এবং রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে তারা যে অঙ্গীকারটা নিতে চাচ্ছেন, আমার মনে হয় যেটা ভালো। আমরা দেখব যে, তারা অঙ্গীকার পরবর্তীতে বাস্তবায়ন কতটুকু করতে পারেন।
রিয়াজ সুমন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০২৫+