ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১, ১১ মার্চ ২০২৫, ১০ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই কেন?

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০০ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২১
পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই কেন? ...

ঢাকা: কোনো ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার ছাড়াই বছরের পর বছর নগর পরিষ্কারের কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্ন স্তরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এ নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না।

এমনকি পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। কিন্তু কেন?

অনেক সচেতন নাগরিক এ নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, দেশের পৌরসভা আর সিটি করপোরেশনগুলো দিনের পর দিন মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।  

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয় না বলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তা ব্যবহার করেন না, নাকি সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তা ব্যবহার করেন না।

সিটি করেপারেশনের দাবি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের গ্লাভস, মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়। কিন্তু তারা সেসব ব্যবহার করেন না। গ্লাভস বা বুট পরে তারা কাজ করতে অভ্যস্ত নন।

অন্যদিকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বলছেন, যেসব সামগ্রী দেওয়া হয় সেগুলো আরামদায়ক নয়। গ্লাভস শক্ত, গামবুট পায়ের মাপে হয় না, রেইনকোট প্রচণ্ড গরম ইত্যাদি।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) অন্যতম শীর্ষ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ন্যূনতম সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরিছন্নতাকর্মীরা সব সময় স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তারা খালি হাতে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছেন, ফলে দুই ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তারা নিজেদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছেন। আবার তারা এই হাত দিয়েই বাসা বাড়ির দরজার হাতল, কলিং বেল, সিঁড়ির রেলিংসহ অনান্য স্থান স্পর্শ করছেন। ফলে অন্যান্যদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ধানমন্ডি, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলি ও কলাবাগানের ডাম্পিং জোনসহ আরও কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা গেছে, সব স্থানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা হ্যান্ড গ্লাভস এবং গামবুট ছাড়াই ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার ও সংগ্রহের কাজ করছেন। করোনার এই সময়ে মুখে মাস্কও নেই।

নগরের রাস্তা ঘাট, হাট-বাজার গৃহস্থালিসহ সব ধরনের বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ করতে হয় পরিছন্নতা কর্মীদের।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মুজমদার বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে তাদের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতাবোধ তৈরি করা দরকার। আমাদের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও এই সচেতানতাবোধ অনুপস্থিত, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে সচেতনতাবোধ আরও কম। এর পরিণতি ভয়ানক। তারা কোনো সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই কাজ করছেন, আবার সেই হাত দিয়েই সব কিছু স্পর্শ করার ফলে অনেক সংক্রামক ব্যাধি ছড়াচ্ছে। তাই আমাদের সবার স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রীর ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। সিটি করপোরেশনের উচিত জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, সিটি করেপোরেশনের অধীনে পাঁচ হাজার ৩৯১ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শীতকালে দৈনিক গড়ে দুই হাজার ৫০০ টন এবং গরমকালে দৈনিক ৩ হাজারের বেশি আবর্জনা উৎপন্ন হয়।

সুরক্ষা সামগ্রী কেন ব্যবহার করছেন না এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশ কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, সিটি করপোরেশন থেকে মাস্ক, গ্লাভস এবং গামবুট দেওয়া হয়েছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আবার যে বুট দেওয়া হয়েছে, তা পায়ের সঠিক মাপের নয় বলেও অভিযোগ অনেকের।

গ্লাভস কেনো পরেননি, এমন প্রশ্নের উত্তরে সিটি করপোরেশনের একজন নারী পরিছন্নতা কর্মী বলেন, যে গ্লাভস দিছে, তা অনেক শক্ত। হাতে দিয়ে কাজ করা যায় না। আমি কিছুদিন কাজ করার পর হাতে ঘা হয়ে গিয়েছিল। হাত দিয়ে ভাত খেতে কষ্ট হতো। সেজন্য আর গ্লাভস পরি না।  

তিনি দাবি করেন, নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের গামবুট দেওয়া হয় না।

অপর এক কর্মী বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে আমাদেরকে রেইনকোর্টও দেওয়া হয়, তবে সেই রেইনকোর্ট পরলে বৃষ্টিতে ভেজার আগেই শরীর ঘেমে ভিজে যায়। তাই ওই রেইনকোর্ট পরে কাজ করা যায় না।

আরও কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, আমরা শীতের মধ্যে রাতে কাজ করি, গায়ে দেওয়ার জন্য গরম সোয়েটার হলে ভালো হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন তা দেয় না। করোনার মধ্যে আমরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। অন্য পেশার লোকজন ঝুঁকিভাতাও পেলেও আমরা কিছুই পাই না। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আরও জানান, আমাদের কাজের জন্য, কাটা কোদাল, টুকরি ও বেলচা প্রয়োজন হয়, এগুলো আমাদের একবার দিলে তিন মাসের বেশি টিকে না, নষ্ট হয়ে যায়। এসব জিনিস ভালো মানের দিলে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হয়।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের খালি হাতে কাজের ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের যে পোশাক এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে, তারা যদি সেগুলো না পরেন, তাহলে একদিকে তারা নিজেরাই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে, অন্যদিকে তার পরিবার ও আশেপাশের মানুষও তার মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। এ কারণেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

নগরীর সব এলাকায় ম্যানহোলে ডুব দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করেন এক শ্রেণির পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তাদেরও লাইফ জ্যাকেট বা অক্সিজেন ব্যবহার করতে দেখা যায় না।  

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডোর বদরুল আমিন বলেন, একজন মানুষকে বর্জ্য পরিষ্কারের জন্য ড্রেনের মধ্যে নামানো একটা অমানবিক কাজ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, যে ব্যক্তি ড্রেনে নামে, সে কিন্তু লাইফ জ্যাকেট পরে ড্রেনের মধ্যে নেমে কাজ করতে পারে না। অক্সিজেনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে, তবে তারা সেগুলো পরে কাজ করতে পারে না। আমরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী মজুদ রাখছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের পরিছন্নতা কর্মীরা গ্লাভস পরে কাজ করতে পারে না, তাদের গ্লাভস পরে কাজ করার অভ্যাস নেই। গামবুট পরেও তারা ড্রেনে কাজ করতে পারে না। বাস্তবতা হচ্ছে তারা গ্লাভস বা বুট পড়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।

প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী পরে কাজের অভ্যাস নেই। আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে এ অভ্যাস গড়ে তোলার। তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ সুরক্ষা সামগ্রী গ্লাভস ও গামবুট  দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন থেকে, ইউএনডিপি এবং রেড ক্রিসেন্ট থেকেও তাদের সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হয়। কেউ কেউ আবার এসব সামগ্রী অন্যের কাছে বিক্রিও করে দেয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০২১
আরকেআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।