ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

সোহাগের যে অনিয়ম ধরা পড়েছে ফিফার তদন্তে

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৩
সোহাগের যে অনিয়ম ধরা পড়েছে ফিফার তদন্তে

আর্থিক জালিয়াতির কারণে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগকে গতকাল (শুক্রবার) দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। পাশাপাশি জরিমানা করেছে প্রায় ১২ লাখ টাকা।

২০১৭ থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফিফার দেওয়া ফান্ডের অপপ্রয়োগ করেছে বাফুফে। সেই দোষেই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে সোহাগকে। সাধারণ কর্তব্য, আনুগত্যের দায়িত্ব ভঙ্গ করার পাশাপাশি জালিয়াতি ও মিথ্যাচার করেছেন তিনি।  

সোহাগের যেসব অনিয়ম ধরা পড়েছে ফিফার চোখে-

ক্রীড়া সামগ্রী কেনা

বাংলাদেশ জাতীয় দল কমিটি ২০২০ সালের জুনে আবাসিক ক্যাম্প ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ম্যাচের জন্য কিছু ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।  যার জন্য দরপত্র জমা দেয় স্পোর্টস লিংক, স্পোর্টস কর্নার ও রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৩০ হাজার ২৭ ডলারের মূল্যের পণ্য কেনার কার্যাদেশ দেন সোহাগ। বিডিংয়ে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব পায় স্পোর্টস লিংক।  

কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপের তদন্তে উঠে আসে, যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বিড করেছিল, সবারই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তিনটি দরপত্রেই ‘কোটেশন’ শব্দটি ‘Outations’ বানানে লেখা। তাদের ফরম্যাটটাও একই। রবিন এন্টার প্রাইজের যে ফোন নাম্বার দেওয়া তাতে কোম্পানির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।  কোনোটিতেই প্রতিষ্ঠানের সিল নেই। দুটি বিডের বক্তব্য শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, ‘...পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। ’ তিনটি কোম্পানির কোটেশন ও টেমপ্লেট একই ব্যক্তি দ্বারা তৈরি করা।  

বিডিও এলএলপির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্পোর্টস কর্নার আর স্পোর্টস লিংক পাশাপাশি ঠিকানায় অবস্থিত। আবার স্পোর্টস লিংকের মালিক রবিনই সম্ভবত স্পোর্টস কর্নারের সাবেক মালিক। তাই গত সেপ্টেম্বরে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া এক রিপোর্টে লেখা হয় যে তিনটি দরপত্রের উৎসই এক—তিনটি আলাদা কোম্পানির নয়।

ফুটবল কেনা

২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৯২১ ডলার দিয়ে ৪০০টি ফুটবল কেনে বাফুফে। যেখানে দরপত্র জমা দেয় তিনটি প্রতিষ্ঠান—মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়া’স ক্লোজেট। নিলাম শেষে ফুটবল সরবরাহের কাজটা ওফেলিয়াসকেই দেওয়া হয়। সেটার অনুমোদন দেন সোহাগসহ পাঁচ কর্মকর্তা।  

এরপর ফেব্রুয়ারিতে সোহাগের নির্দেশে ওফেলিয়া’স ক্লোজেটকে ‘ফাইনাল পেমেন্ট’ করা হয়। সোহাগের স্বাক্ষরকৃত কাগজে লেখা থাকে, ‘ফিফা অনুমোদিত বাফুফের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০১৯–২০ মৌসুমের ম্যাচ পরিচালনার জন্য এই কেনাকাটা প্রয়োজন। ’ ব্যাখ্যায় বলা হয়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রীড়াপণ্য সরবরাহ করে থাকে।  

কন্ট্রোল রিস্কের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওফেলিয়া’স ক্লোজেটের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটার কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা নারীদের পোশাক সেলাই করে। তাই ফুটবল বিক্রি করা তাদের পক্ষে অসম্ভবই বলা যায়।  বাফুফেকে ফুটবল সরবরাহের প্রতিষ্ঠান নয় এটি। মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের দরপ্রস্তাবে তাদের খুঁজে পাওয়ার মতো তথ্য নেই। কোনো সিল নেই দরপ্রস্তাবে। তাদের অস্বিত্ব আছে কি না সেই ব্যাপারেও কোনো মন্তব্য করতে পারেনি কন্ট্রোল রিস্ক।

বিডিওর রিপোর্টে বলা হয়, ওফেলিয়া’স এর ফুটবল সরবরাহের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাদের আমদানি সনদও নেই। তবে এক বন্ধুর সনদ ব্যবহার করা হয় বলে জানিয়েছেন ওফেলিয়া’স এর মালিক। ওফেলিয়া’স ক্লোজেট থেকে কোনো চালান না পাওয়া সত্ত্বেও বাফুফে প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থ পরিশোধ করে।  

ফিফার মতে এটি স্পষ্ট যে সব কটি দরপ্রস্তাবই বানোয়াট ও অন্যকিছু লুকানোর উপাদান ছিল এতে। ফটোকপিতে মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল ও এইচ ইউ জামান ট্রেডিংয়ের স্বাক্ষরিত দরপত্র দেওয়া হয়েছে, মূল কাগজ নয়।  

বিমানের টিকিট
 

কাতার বিশ্বকাপ প্রাক বাছাই পর্ব খেলার জন্য ওমান সফরে যায় বাংলাদেশ জাতীয় দল। সেই সফরে ফ্লাইটের টিকিট বাবদ আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার প্রদান করে বাফুফে। এক্ষেত্রে অবশ্য আরও দুটি প্রতিষ্ঠান- পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের দরপ্রস্তাব পান সোহাগ। অক্টোবরে আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে অর্থ প্রদানের অনুমোদন দেন তিনি। ফিফা ফরোয়ার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে দুটি চেক ইস্যু করা হয়।  

তিনটি দরপ্রস্তাবই শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে, যেখানে রুট (route)  শব্দটি একই বানানে লেখা ‘rout’। সংখ্যার ভুলগুলোও একই রকম (১, ৩, ৪), একই তারিখে জমা দেওয়া। কন্ট্রোল রিস্কের মতে, পূরবী ইন্টারন্যাশনাল একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাই বিমানের টিকিট কেনায় তাদের দরপ্রস্তাব দেওয়ার কথাই আসে না।  অন্যদিকে মাল্টিপ্লেক্স একটি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান হলেও তারা দরপ্রস্তাব দেয়নি বলে নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
ঘাস কাটার টিকিট

২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৪১২ মার্কিন ডলারে ঘাস কাটার যন্ত্র কেনে বাফুফে। দুটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়। একটি বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার, আরেকটি শোভা এন্টারপ্রাইজ। যেখানে বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার টেন্ডার দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর যন্ত্র কেনার নির্দেশ দেন সোহাগ। কিন্তু এর দুই দিন পর শারমিন এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দেয়। ১০ ফেব্রুয়ারি ফিফা মনোনীত ব্যাংক একাউন্ট থেকে চেক ইস্যু করা হয় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার নামে।  

এখানে পাওয়া অনিয়মের মধ্যে আছে বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার প্রতিষ্ঠানের নামের বানানে ভুল। শোভা এন্টারপ্রাইজ আর শারমিন এন্টারপ্রাইজের দরপ্রস্তাব দেখতে এক রকম। শারমিন এন্টারপ্রাইজে যোগাযোগ করলে তারা নিজেদের শোভা এন্টারপ্রাইজ হিসেবে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশ হার্ডওয়্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ফিফার এই বলে উপসংহারে আসে যে, সব দরপত্রই একই জায়গা থেকে করা হয়েছে।

এছাড়া ওয়াটার পাইপলাইন বসানো ও সংস্কারের জন্য মোহাম্মদ শফিক, মেসার্স হোসেন এন্টারপ্রাইজ ও মানিক এন্টারপ্রাইজ থেকে দরপ্রস্তাব পায় বাফুফে। প্রতিটি দরপ্রস্তাবই একইরকম। সেখান থেকে টেন্ডার দেওয়া মোহাম্মদ শফিককে। নিলাম প্রক্রিয়া অনুযায়ী আড়াই লাখ টাকা দেওয়ার কথা বাফুফের। কিন্তু পানির পুরনো লাইন সংস্কার করার জন্য শফিককে ৫০ লাখ টাকা বেশি দিয়েছে তারা।   

বাফুফে গঠনতন্ত্রের ৫৯ ধারায়তে লেখা আছে, ফেডারেশনের হিসাব ব্যবস্থাপনা ও ফিফার যোগাযোগের দায়িত্ব সাধারণ সম্পাদকের। প্রতিটি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অনিয়মের দায় এড়াতে পারেন না সোহাগ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৩

এএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।